মনিরুজ্জামান টিটো ॥
আসন্ন উপজেলা বিএনপি’র কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে মণিরামপুরে নেতা-কর্মীদের মাঝে নতুন করে প্রাণ চাঞ্চল্যতার সৃষ্টি হয়েছে। শীর্ষ দু’টি পদ দখলের লড়াইয়ে একের পর এক শো-ডাউনসহ জেলা ও উর্দ্ধতন নেতাদের কাছে দৌড় ঝাঁপসহ তৃণমূলের সমর্থণ পেতে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন পদ প্রত্যাশীরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে উপজেলা বিএনপি’র কাউন্সিল।
দলীয় বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায়, প্রায় দশ বছর পর মণিরামপুর উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠন হতে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে সর্বশেষ সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত উপজেলা কমিটি বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৭ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার সর্বমোট ১৬২ টি ওয়ার্ডের কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়েছে। ওই সময় জেলা বিএনপি পক্ষ থেকে সকল উপজেলা কমিটি গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক নার্গিস বেগমকে প্রধান করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানায়।
এদিকে দীর্ঘদিন পর কমিটি গঠনের খবরে নেতা-কর্মীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি জেলা ও সিনিয়ার নেতা-কর্মীদের কাছে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন পদ প্রত্যাশীরা। সভাপতি পদে এখন পর্যন্ত বর্তমান সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র এড. শহীদ ইকবাল হোসেনের কোন প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা না মিললেও সাধারন সম্পাদক পদ নিয়েই পৌরশহরসহ উপজেলাব্যাপী নেতা-কর্মীরা আলোচনায় সরগরম করে তুলেছেন।
উপজেলা বিএনপির দীর্ঘদিনের দু’টি বলয়ের মধ্যে বিদ্যমান গ্রুুপিং-এর বাইরেও এবার স্ব-স্ব উদ্যোগে একাধিক পদপ্রত্যাশী আত্মপ্রকাশ করায় নতুনমাত্রা সৃষ্টি হয়েছে। তবে গ্রুপের ক্ষেত্রে আলহাজ্¦ মো: মুছা গ্রুপে বর্তমানে বেশ ইমেজ সংকট চলছে। এর কারণ স্বরূপ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওয়ান ইলেভেনের পর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে কর্নেল ওলি আহম্মেদের এলডিপি’তে যোগদানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের বিএনপি’র রাজনৈতিক জীবনে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন। সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাকালিন সময় থেকেই জনপ্রিয় এই নেতা অবশ্য পরবর্তীতে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইসলামের সহায়তায় আবারো ঘরে ফিরে আসেন এবং সে বারেই বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেন। সেই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। তবে ওই নির্বাচনে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী শহীদ ইকবালের সহধর্মীনি মেরী ইকবাল তার থেকে প্রায় তিন হাজার ভোট বেশী পেয়েও পরাজিত হয়। মূলত: দল পরিবর্তন করায় তিনি তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আবারো বিগত ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে ব্যর্থ হন তিনি। ওই নির্বাচনে উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক এস, এম মশিউর রহমান বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আলহাজ্ব মো. মুছা অনেকটা সরাসরি জামায়াত প্রার্থীর পক্ষে সাফাই নির্বাচনে অংশ নিলে তার দলীয় অবস্থান চরম ভাবে ক্ষতির সন্মূখীন হয়। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে এখনও। অনেকটা দলের অভ্যন্তরিন জনপ্রিয়তা হারিয়ে চির প্রতিদ্বন্দ্বী সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার সাহস পর্যন্ত হারিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
তৃণমূলের অভিযোগের কমতি নেই বর্তমান সভাপতি আলহাজ্ব এড. শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধেও। বিএনপি শাসনামলে কর্মী অবমূল্যায়সহ নানা অভিযোগ থাকা স্বত্বেও দলের চরম দূ.সময়ে নেতা-কর্মীদের আগলে রেখে ঠিকই নিজের জনপ্রিয়তার ধারা অব্যহত রেখেছেন। প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে সর্বদা পাশে রয়েছেন নেতা-কর্মীদের। যুগিয়ে চলেছেন সাহস। যে কারনে তিনি এবারও নিরুংকুষভাবে সভাপতি হতে চলেছেন এটাই ধারনা সর্বস্তরের।
দলের অপর গূরুত্বপূর্ণ সাধারন সম্পাদক পদের লড়াইয়ের দিকেই মূলত চেয়ে আছে নেতা-কর্মীরা। একটি পদের বিপরীতে প্রায় হাফ ডজন নেতা দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছেন। বিভিন্ন সময়ে উপজেলার একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তের নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিতে দেখা গেছে অনেকেরই। বিশেষ করে কোন অসুস্থ বা মৃত নেতা-কর্মীর বাড়িতে পদ প্রত্যাশীদের পদচারণা উল্লেখ্যযোগ্য। এ দৌড়ে ছুটে চলেছেন বর্তমান সাধারন সম্পাদক ও শ্যামকুড় ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এস, এম মশিউর রহমান। বিগত উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে খুবই নগন্য ভোট পাওয়ার পর থেকে প্রায় বছর চারেক তার দেখা পাওয়া না গেলেও কমিটি গঠনের খবরে আবারো সরগরম তিনি। প্রায় দু’ডজন রাজনৈতিক মামলায় আসামী হয়ে হুলিয়া নিয়ে এতোদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন বলে তার অনুসারীদের দাবি। একই পদ পাওয়ার আশায় রয়েছেন খানপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এড. মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে চাওয়া পাওয়ার শেষ পর্যায়ে তিনিও এ পদের জোর দাবিদার। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সকল আন্দোলন সংগ্রামে তার অগ্রনী ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। দলের চরম ক্রান্তিলগ্নেও নেতা-কর্মীদের পাশে ছিলেন তিনিও। আজও অবিরাম দলীয় সকল কর্মসূচীতে তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপি’র রাজনীতিতে অবিচল থাকায় তৃণমূলে তার রয়েছে শক্ত বলয়।
একই পদে প্রদ্বিন্দ্বিতায় অবতীর্ণ রয়েছেন ঢাকুরিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জিএম মিজানুর রহমান। তিনিও প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক মামলার আসামী। মূলত. এবারের সন্মেলনে তিনি সাবেক সভাপতি মুছার অনুসারী হিসেবে বেশী পরিচিত য়েছেন।
অপর প্রার্থী রাজনৈতিক ক্লিন ইমেজিং লেডার খ্যাত এড. মকবুল ইসলাম। বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি। দ্বিতীয় বারের মতো সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন বিশেষ ‘কেয়ার অব’এ। তবে রাজনৈতিক জীবন দশায় কোন ঝুঁকি বা হামলা-মামলায় জড়াতে হয়নি তাকে। সকল রাজনৈতিক দলের সাথে ক্লিন ইমেজ বজায় রাখায় নিজেকে অনেকটা হামলা-মামলার সেভ জোনে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বিগত কয়েক বছরে উপজেলার কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর নামে হামলা-মামলা হলেও এড. মকবুল ইসলাম রয়েছে সে বলায়ের বাইরে।
অপর প্রার্থী উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কাউন্সিলর মফিজুর রহমান। তিনিও বহু মামলার আসামী। দলের দূর্দিনে তার ভূমিকা রয়েছে বেশ এগিয়ে। একসময় অর্থ সম্পাদক পদে থেকে দলের যোগান দিয়েছেন তিনি। অপর প্রার্থী ও সর্ব কনিষ্ঠ ইয়াং লেডার খ্যাত আসাদুজ্জামান মিন্টু। বয়সে তরুন হলেও তার রয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। সাধারন সম্পাদক পদে সর্বোচ্চ নেতা-কর্মীদের প্রিয় প্রার্থী হিসেবে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে তিনি উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি, উপজেলা যুবদলের সাধারন সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা যুবদলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সাথে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক পদে। বিএনপি’র প্রায় সকল দূর্দিনে, সকল আন্দোলন সংগ্রামে তার নেতৃত্ব শুধু বিএনপি নয়, আন্দোলন সংগ্রামের দিক থেকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভূতিকাকেও ছাপিয়ে যায়। যার নেতৃত্ব ছাড়া যেন মণিরামপুর বিএনপির আন্দোলনই পানসে, তিনিও প্রায় ডজন দু’য়েক রাজনৈতিক মামলার আসামী হয়ে জেল খেটেছেন বহুবার। তিনিও আশাবাদি সাধারন সম্পাদক পদ নিয়ে। তৃণমূলের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হলে তিনিই এগিয়ে থাকবেন এমন মন্তব্য পাওয়া গেছে বিএনপি দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে।
তবে সাধারন সম্পাদক পদের অধিকাংশ প্রার্থীই তাদের স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের পাশাপাশি তৃণমূলের মতামতে নির্বাচিত হওয়ার আশা ব্যক্ত করেছেন। উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র আলহাজ্ব এড. শহীদ মো. ইকবাল হোসেন বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন বাঁধা না আসলে স্বল্প পরিসরে হলেও একটি সুন্দর আয়োজনের মধ্যদিয়ে তৃণমূলের মতপ্রকাশের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। বিএনপি গণতান্ত্রিক চর্চার রাজনৈতিদক দল উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, নেতা নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির মতামতকে গূরুত্ব দেওয়া হবে। পাশাপাশি দলের এই শংকটমূহুর্তে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরে গ্রুপিং সৃষ্টি করে, খালেদা জিয়া মুক্তি আন্দোলন যাতে বাঁধাগ্রস্থ না হয় তার জন্য উপজেলা সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সবমিলিয়ে মণিরামপুর উপজেলা বিএনপি’র কাউন্সিল নিয়ে সরগরম মণিরামপুরের রাজনৈতিক অঙ্গণ। তবে তৃণমূল বিএনপি চায় তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। নেতা নির্বাচণে গতানুগতিক পন্থায় কমিটি নয়, সরাসরি কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে হোক এটাই তাদের প্রত্যশা।