ঢাকাবুধবার , ৩০ মার্চ ২০১৬
আজকের সর্বশেষ সবখবর

টানা ৮ বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আবারো বাহাদুরি দেখালেন সরদার বাহাদুর আলী

admin
মার্চ ৩০, ২০১৬ ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

IMG_20141130_163922মনিরুজ্জামান টিটো : মণিরামপুর উপজেলার অত্যন্ত অবহেলিত এবং দূর্গম একটি ইউনিয়নের নাম দূর্বাডাঙ্গা। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার পথ। মণিরামপুরে রাস্তাঘাটের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এখন ১৫/২০ মিনিটের পথ হলেও সেদিন ছিল প্রায় ঘন্টা খানেকের পথ।

বলছিলাম ৫০ বছরেরও আগের কথা। উপজেলা সদরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা একমাত্র ইট আর পাথরের খোয়ায় তৈরী যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে এ ইউনিয়নের গ্রাম গুলোতে যাওয়ার সবগুলো রাস্তাই তখন কাঁচা। মোটা মাটির এলাকা হওয়ায় বৃষ্টির দিনে আটার মতো কাঁদা, আবার শুকনোর সময় ভিষণ অসম রাস্তা গুলো। এক সময়ে সর্বহারা ও আন্ডার ওয়ার্ল্ড অধ্যুষিত এ ইউনিয়নের গ্রাম গুলোতে ৫০’র দশকে ব্যপক হারে চুরি-ডাকাতি বৃদ্ধি পায়। এলাকাবাসি তাদের জানমাল রক্ষা করতে প্রায় ব্যর্থ। ঠিক তখনই সবে মেট্রিকুলেশন পাশ করে এলাকায় এসে এসবের প্রতিবাদ শুরু করেন ১৬ বছরের এক বাহাদুর যুবক। ইউনিয়নটির বর্তমান চেয়ারম্যান তিনি। ১৯৭৩ সালে ইউনিয়ন রিলিফ কমিটি বাতিল ও ইউনিয়ন পরিষদ আইন পাশ এবং চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টির পর থেকে ৮ বার নির্বাচিত হয়ে ৪০ বছর যাবত এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী প্রবীন আওয়ামীলীগ নেতা সরদার বাহাদুর আলী। এবারো বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। সত্যিই তিনি একজন বাহাদুর।

১৯৪২ সালের ৩০ জুন উপজেলার দূর্বাডাঙ্গা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম দত্তকোনার এক কৃষক পরিবারের জম্মগ্রহন করেন সরদার বাহাদুর আলী। বাবা সরদার আছির উদ্দিন ও মাতা মকরজান বেগমের একমাত্র ছেলে সরদার বাহাদুর আলী। আর্থিক দৈন্যতার কারনে ছাত্রজীবনে তাকে হোঁছট খেতে হয়েছে বহুবার। নেহালপুর প্রাইমারী স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেনী পাশ করে ভর্তি হন গোপালপুর হাই মাদরাসায়। সেখানে এক মামার বাড়িতে থেকে ৮ম শ্রেনী পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকুরিয়া হাই স্কুলে। সেখানেও অন্যের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৮ সালে তৎকালিন ইষ্ট পাকিস্থান সেন্ট্রাল বোর্ডের অধীনে মেট্রিকুলেশ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বে সাথে পাশ করেন এই মেধাবী ছাত্র। এবার উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের পালা। কিন্তু সরদার বাহাদুর আলীর কাছে সেটা তখন শুধুই স্বপ্ন। আর্থিক অস্বচ্ছলতা ঘুচাঁতে সে বছরেই যোগদেন শিক্ষকতায়। মাত্র সাড়ে ৩৬ টাকা বেতনে সাতগাতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। বাবার সংসারে খেয়ে প্রায় ২ বছর সেখানে শিক্ষকতা করার পর, কিছু অর্থ জমিয়ে আবারো পা বাড়ান শিক্ষা জীবনে। চাকরী ছেড়ে ভর্তি হন যশোরের ঐতিহ্যবাহী মাইকেল মধুসুদন কলেজে। যা এমএম কলেজ নামে পরিচিত। অর্থনীতি ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনাকালীন সময় জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে।

সম্প্রতি মণিরামপুরের দত্তকোনা গ্রামে তার নিজ বাড়িতে একান্ত সাক্ষাতকারে জানালো এসব কথা। কিভাবে এবং কেনই বা রাজনীতিতে আসলেন ? জানতে চাইলে শুনালেন তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের কথা। সঠিক দিনক্ষণ না বলতে পারলেও জানালেন, ১৯৬১ সালের কোন এক সময় যশোর ঈদগাহ ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক জনসভায় আসার কথা। মন দিয়ে শুনলেন বাঙ্গালী জাতিকে স্বত্তামুক্ত করার ভাষন। সেই ভাষনেই মেধাবী ছাত্র বাহাদুরের মাঝে সৃষ্টি হয় রাজনীতিক চেতনা বোধ। শুরু করেন ছাত্রলীগের রাজনীতি। এমএম কলেজ ছাত্রলীগের তুখোড় এই ছাত্রনেতা ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের পর গ্রামে ফিরে আসেন। মাধ্যমিকে ভাল ফলাফলের দৃঢ়তা নিয়ে ফল প্রকাশের আগেই শুরু করেন কর্মস্থানের চেষ্টা। সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদেন ঝাঁপা হাই স্কুলে। মাত্র ২ মাস শিক্ষকতা করার পর নিজ গ্রাম দত্তকোনাসহ অবহেলিত দূর্বাডাঙ্গা ইউনিয়নের মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রয়াসে ফিরে আসেন বাড়িতে। এলাকার কয়েক জন মুরুব্বীদের সাথে আলোচনা করে ডাক দেন আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ। এলাকাবাসির সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। মাধ্যমিকের ফল প্রকাশে পর ১ জুলাই সেখানেই সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন সরদার বাহাদুর আলী। ১৯৯৮ সালে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে ওই বিদ্যালয়েই সর্বমোট ৪০ বছর শিক্ষকতা জীবন শেষ করে ২০০২ সালের ৩০ জুন অবসর গ্রহন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিবাদী যুবক হিসেবে পরিচিত পান তিনি। এলাকায় ব্যপকহারে বৃদ্ধি পাওয়া চুরি-ডাকাতি ঠেকাতে বলিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহন করেন যুবক বাহাদুর। এলাকার কয়েক জন যুবককে সাথে নিয়ে শুরু করেন প্রতিবাদ। গ্রামে চুরি হলেই ধরে নিয়ে আসেন চিহ্নিত চোরদের। বাধ্য করেন চুরি যাওয়া মালামাল ফেরত দিতে। ব্যপক সমর্থন পেয়ে তারই নেতৃত্বে চুরি প্রতিরোধে আশেপাশের গ্রামে গুলোতেও গঠন করেন চুরি প্রতিরোধ কমিটি। অল্প সময়েই বন্ধ করেন চুরির প্রবনতা। পাশাপাশি নিজের ভিতর লালন করা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বিকশিত করতে চালিয়ে যান সাংগঠনিক কার্যক্রম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালে সরকার রিলিফ কমিটি বাতিল করে ইউনিয়ন পরিষদ আইন প্রণয়ন করলে এলাকাবাসির চাপে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। বাবা সরদার আছির উদ্দিন একমাত্র ছেলেকে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করতে প্রথমে অসম্মতি জানালেও পরে এলাকাবাসির অনুরোধে সম্মত হন। বাবা-মা’র দোয়া নিয়েই শুরু করেন নির্বাচন। জীবনের প্রথম নির্বাচনেই বাজিমাত। বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন তিনি। ৩ বারের নির্বাচনে টানা ১৫ বছর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে মাত্র ৬৯ ভোটে পরাজিত হন। তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ কমিয়ে ৪ বছর করায় ৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবারো জয়লাভ করে টানা ২৫ বছর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে এমএম কলেজের ছাত্র রাজনীতি থেকে এলাকায় শুরু করেন নানা সাংগঠনিক তৎপরতা। ১৯৬৫ সালে মণিরামপুরে রাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর এক জনসভা সফল করতে ব্যপক ভূমিকা রাখেন তিনি। সেদিনই প্রথম বঙ্গবন্ধুর সহচার্য্য পান। অবশ্য পরে কয়েকবার দেখা করার সৌভাগ্য হয়। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীদের দূর্বাডাঙ্গা ইউনিয়ন কমিটির সাধারন সম্পাদক এবং থানা কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। পরে ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি এবং থানা কমিটির সম্পাদক মন্ডলির সদস্য নির্বাচিত হন। ৬৯’র গণ আন্দোলনে বলিষ্ট ভূমিকা রাখেন এই নেতা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্থানীয় রাজাকারদের ভয়ে কিছুদিন পালিয়ে থাকার পর শিক্ষকতার সুবাদে রাজাকারদের কঠোর নজরদারিতে আবারো এলাকায় ফিরে আসেন। তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাবে সহযোগীতা করেন অতি গোপনে। পরে ১৯৮৬ সালে থানা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে টানা ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করেন।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দূর্বাডাঙ্গা ইউনিয়নকে শতভাগ স্যানিটেশন, নিরক্ষর মুক্ত, বাল্য বিবাহ মুক্ত ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু উপজেলা নয়, জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে অর্জন করেছেন জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ট ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হবার গৌরব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট থেকে গ্রহন করেছেন সন্মাননা পদক। ইউনিয়নে গড়ে তুলেছেন একাধিক শিক্ষা কল্যান ট্রাস্ট, লাইব্রেরী, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, সমবায় সমিতিসহ মসজিদ-মন্দির। একাধিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতিসহ গূরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন কিংবদন্তি এই নেতা। নিজের ইউনিয়েেনর জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে ছোট-খাটো বিবাদ স্থানীয় ইউপি কার্যালয়ে সমাধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন উন্নত আইন-শৃংখলা। এলাকাবাসির সহায়তায় এক সময়ের সর্বহারা তথা আন্ডার ওয়ার্ল্ড অধ্যুষিত দূর্বাডাঙ্গা ইউনিয়নটিকে সন্ত্রাস মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রবীন এই নেতা ব্যক্তিগত জীবনে ৫ কন্যা ও ১ ছেলে সন্তানের জনক। সন্তানরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। বড় মেয়ে শিরিন আকতার জেসমিন বিএবিএড পাশ করে নওয়াপাড়ায় একটি আধুনিক মানের ক্লিনিক পরিচালনা করছেন। ২য় মেয়ে ডলি আকতার পারভীন বাংলায় মাষ্টার্স করে স্বামীর সংসার করছেন। ৩য় মেয়ে তহমিনা আকতার নাসরিনের মাধ্যমিক পাশের পরেই বিয়ে হয়। ৪র্থ মেয়ে ফজিলা আকতার নাজনীন মাষ্টার্স শেষ করে সংসার করছে এবং ৫ম মেয়ে শারমীন আকতার সবে পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়াশোনা শেষ করেছে। একমাত্র ছেলে এস,এম আলমগীর শরীফ মুকুল মণিরামপুর ডিগ্রী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের আদর্শকে লালন করে আজও শক্ত হাতে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমের পাশাপাশি সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিজেকে আত্ম নিয়োগ করে চলেছেন সরদার বাহাদুর আলী। ৭৪ বছরে পা রাখলেও মানুষের বিপদে-আপদে রাত-দিন ছুটে বেড়ান এখনো। তাতে আপত্তি করেনা পরিবারের অন্য সদস্যরা।

সরদার বাহাদুর আলীর কর্মকান্ডে শুধু দত্তকোনা গ্রামের মানুষ নয়, গোটা ইউনিয়নবাসি নিজেদেরকে গর্বিত মনে করেন।

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।