এস.এম. হাফিজুর রহমান ।।
এগিয়ে যাওয়া বিশ্বকে গতিরোধ করে থমকে দিয়েছে মৃত্যু ঘাতক করোনা। গোটা পৃথিবীর চলমান উন্নয়নের চাকা শিকলে বন্দি হয়ে বাধ্য হয়েছে মানুষ এই অস্বস্তির ঘরবন্দী হতে। বলা যেতে পারে পরিস্থিতির আলোকে এক মহাবিপর্যায়ের দিকে পতিত হতে যাচ্ছে পুরো বিশ্ব। গোটা দুনিয়াবাসীর সাথে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে জনবহুল জনপদ বাংলাদেশও। হু হু করে করোনা ভাইরাস যেন বিস্তার না করতে পারে সেই জন্য সরকারের নির্দেশে মানুষ স্বইচ্ছায় গৃহবন্দী হয়েছে। জেকে বসা মরনব্যাধী করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ লড়াই করছে মানুষ। এই অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লড়তে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে মানুষকে। অচেনা অজানা দৃশ্যহীন ব্যাধিকে মোকাবেলা করতে দিশেহারা হচ্ছে উচ্চ পর্যায় থেকে নিন্ম পর্যায়ের সকলে।
বিশ্বের উন্নয়নে অংশিদার হতে কেবলমাত্র মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে শুরু করেছি আমরা, ঠিক সেই সময় আচমকা আঘাত দীর্ঘ বছর এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে পিছন থেকে টেনে ধরেছে সমসাময়িক পরিস্থিতি। অপ্রতিরোধ্য গতির সুইচ সাময়িক বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ। আঠারো কোটি মানুষের ছত্রিশ কোটি হাত আজ ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে। কর্মমুখী মানুষের মুখয়বে হতাশা আর নিদারুন বিষন্ন রেখার স্পস্ট ছাপ ফুটে উঠেছে। করোনার এই তীব্র থাবার স্রোতে ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে থামবো আমরা সেটা আমাদের অজানা। করোনার রাহুগ্রাসে বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবী দুমড়ে মুচড়ে শক্তিহীন হয়ে নিরব নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরীতে পরিনত হতে চলেছে।
ঘরবন্দী মানুষ, অচল অর্থনীতির চাকা, জনজীবন বিপন্ন। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায় ধেয়ে আসছে এক কঠিনতর ভঙ্গুর পরিস্থিতি যার ভার বহন করা অসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়াবে। বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়ার সীমান্ত রেখা মুছে দিয়ে জোটবদ্ধ হযে আজ এক আকাশের নিচে দাড়িয়েছে সকল মানুষ। সামান্য এই করোনা ভাইরাস আমাদের চলমান জীবনের গতিবিধি পাল্টাতে বাধ্য করেছে। চারিদিকে বেঁচে থাকার আত্মচিৎকার ধ্বনিত হচ্ছে। বিশাল গতির পৃথিবী আজ মহাক্লান্ত, সমস্ত আকাশ ভারী হয়ে শোকের প্রচ্ছদে রূপ নিয়েছে। কেউই জানেনা এই সংগ্রামের শেষ কোথায়। প্রত্যেকটি সংগ্রামের নিজস্ব একটা চরিত্র থাকে কিন্তু এ সংগ্রাম, সম্পূর্ণ অদৃশ্য ও অচেনা অজানার সাথে।
অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া সকল ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আজ তালাবন্দী। অধিকাংশ উৎপাদন ও ক্রয় বিক্রয় থমকে গিয়েছে। দিন যত অতিবাহিত হচ্ছে ততই সমস্যা প্রকট হয়ে, আমাদের ঘিরে ধরছে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষ গৃহবন্দী হয়ে কর্মহীনে পরিনত হয়েছে। দেশে লক্ষ্য লক্ষ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কর্মজীবি মানুষ আছে যাদের প্রতিদিনের উপার্জনের অর্থ দিয়ে সংসারের চাকা সচল থাকে। সেইসব জনগোষ্ঠী ইতোমধ্যে ভয়াবহ এক নিদারুন দুর্দিনের ভিতর বন্দি হতে চলেছে। চলমান সকল পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সরকারকে নতুন পলিসি অবলম্বন করতে হবে। দেশের সকল নাগরিক যেন অনাহারে দিনাতিপাত না করে সেই দিকে নজর দিতে হবে, সাথে সাথে এই ভয়াবহ দূর্যোগ কেটে উঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে; এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে।
দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সকল প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশের মানুষ এ স্তবির জীবনে অভ্যস্থ নয়। তবে করোনার এই ভয়ংকর ছোবল থেকে বাঁচতে আমাদের সকলকে অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে থেকেই এর প্রতিরোধ খুঁজতে হবে। করোনার থাবায় শুধু বাংলাদেশ আক্রান্ত নয়, বিশ্বে ১৯৯টি দেশ ইতোমধ্যে এর ছোবল থেকে রেহাই পায়নি। শুধু তাই নয়, করোনা আক্রান্তে সারাবিশ্বে এই পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করেছেন ৩০ হাজার ৩১৩ জন মানুষ। ৬ লাখ ৫২ হাজার ৭৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন, আর আক্রান্ত হওয়ার পর বিশ্বে সুস্থ হয়েছেন এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩৯ হাজার। সুতারাং এ ভাইরাসের গতি দিন দিন উর্দ্ধমুখী, নিম্নমুখী নয়। এ ভাইরাসের সংক্রমন থেকে বাঁচতে একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমরা। তাই নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে আমাদের।
অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি জনপদ। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অধিক জনগোষ্ঠীর বসবাস এ ভুখন্ডে, এজন্য আমাদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। তারপরেও করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে যেভাবে আক্রমনের ডালপালা বিস্তার করেছে সেই তুলনায় বাংলাদেশ আক্রান্তের পরিমাণ অত্যন্ত লঘু। ২৮ মার্চ পর্যন্ত দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮ জন, আক্রান্তের মধ্যে ১৫ জনকে সুস্থ করতে সখ্যম হয়েছে আমাদের চিকিৎসকগণ, আর খুবই পরিতাপের বিষয় ৫ জনকে আমরা হারিয়েছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতি মূহুর্তের নির্দেশনা যথাযত পালন করার মধ্য দিয়ে আমরা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাবো। ১৮ কোটি মানুষের এ দেশ, আমরা আর একজনকেও হারাতে চাইনা। তাই করোনার গতিকে রোধ করতে স্বাস্থ্য সচেতনতার বিকল্প নেই।
এ গৃহবন্দিত্ব আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র মহা লড়াই। ইতিহাস বার বার সাক্ষ্য দেয় বাংলাদেশের মানুষ কোন দিন হারেনি। মনে রাখতে হবে ১৮ কোটি মানুষের চেয়ে করোনা ভাইরাস শক্তিশালী নয়। এই মূহুর্তে আতংকিত না হয়ে বরং সতর্কতাই বেশি জরুরী। দৃঢ় মনোবল রাখুন, শ্বাসরুদ্ধকর সব পরিস্থিতি কেটে উঠবে বাংলাদেশ। সব পরিস্থিতি কেটে উঠলে আবার ঘর থেকে সকলে মিলে একসঙ্গে বের হয়ে অর্থনীতির চাকা দ্রুত গতিতে ঘুরাবো। ৩৬ কোটি হাতের স্পর্শে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ স্বমহিমায় ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা হারেনি, আমরা হারবো না। এ জনপদ আবার জেগে উঠবে, মুখরিত হবে সকল প্রাঙ্গন। সকল অন্ধকার কেটে, আলোর টগবগে আভা নিয়ে নতুন সকালের আগমন ঘটবে লাল সবুজের এ ভুখন্ডে।
লেখক:
প্রতিষ্ঠাতা, নিসু ফাউন্ডেশন
চেয়ারম্যান, অক্সফোর্ড স্কুল এন্ড কলেজ, গাজীপুর।