ঢাকারবিবার , ২১ ডিসেম্বর ২০১৪
আজকের সর্বশেষ সবখবর

একজন খুনী কিভাবে দেশপ্রেমিক হলো

admin
ডিসেম্বর ২১, ২০১৪ ২:১৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বছর দু’য়েক আগের কথা। খবরে প্রকাশ, আরব আমীরাত আদালত এক বাংলাদেশীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে। তার অপরাধ সে এক পাকিস্তানীকে রান্নার বটি দিয়ে দুই টুকরো করে ফেলেছে। খবরটি শুনে অবাকই হলাম। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন রাখলাম- শেষমেষ বিদেশের মাটিতে বাঙালিরা অপরাধ জগতে জড়িয়ে গেলো?

আমার জীবনের প্রায় বারো বছর আমি আমীরাতে কাটিয়েছি। আমার প্রচুর বন্ধু-বান্ধব সেখানে। আমি থাকা অবস্থায় কোন বাংলাদেশীর মুত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে শুনিনি। মধ্যপ্রাচে্য যত অপরাধ হতো তার ৯৯ ভাগ অপরাধী ছিল পাকিস্তানী, সুদানী এবং সোমালীরা। এখনও চুরি হলে প্রথম নাম আসে সুদানী এবং সোমালীর। ধর্ষন এবং ড্রাগসএর অপরাধী হলে প্রথম নাম আসে পাকিস্তানীর। বুঝা যায় জন্ম থেকে এই জাতিগুলি অপরাধী। বাঙালিরা আরবীদের কাছে মিসকিন জাতি হলেও খুবই বিশ্বস্ত। বাঙালিরা দেশে যাই করুক বিদেশে সৎ জীবন যাপন করে। বাঙালীরা চুরি করে না, ড্রাগস-এর ব্যবসা করে না, ধর্ষণ, খুন তথা কোন ধরনের অপরাধে জড়িত হয় না। সময়ের আগে বাঙালিরা কর্মস্থলে পৌঁছায়। নিয়োগকর্তাদের মধে্য বাঙালিরা হচ্ছে প্রথম পছন্দ।

ঘটনার পূর্বাপর: আরবীদের পুরনো একটি বড় বাড়িতে বেশ ক’জন ব্যাচেলর বাঙালি, পাকিস্তানী, ভারতীয় কয়েকটি রুম ভাগাভাগি করে বসবাস করতো। পেশায় এরা সবাই সাধারণ শ্রমিক। তারা বিভিন্ন কন্ট্রাকটারদের অধীনে ঠিকা কাজ করে। এক শুক্রবার ছুটির দিন বিকেলে দুই রুমমেট রান্নার জন্য তরকারি কুটছিল। রুমের ভেতর ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে বাংলা গান। এমন সময় ঐখানে এক পাকিস্তানীর আগমন ঘটে। একথা, সেকথা বলার পর এক পর্যায়ে কটাক্ষ সূরে সে বলতে শুরু করে- তোমাদের খাওয়া দাওয়া, চলা-ফেরা সব ইণ্ডিয়ানদের মতো। একজন উত্তর দেয়-ইণ্ডিয়ানদের মতো হতে যাবে কেন? আমরা আমাদের মতো করে খাই, আমরা আমাদের ষ্টাইলে চলি। আমরা স্বাধীন। মুর্খের মতো কথা বলো কেন? পাকিস্তানীটি তখন তাকে বলে তোমাদের জন্মটা কি আমার অজানা? ইণ্ডিয়াকে পাকিস্তানীরা …. করে গাভিন করেছিল আর তারপরে তোমাদের ঐ তথাকথিত সোনার বাংলার জন্ম। এক বাঙালি তখন তাকে মুখ সামলে কথা বলার জন্য অনুরোধ করে। অন্য বাঙালিটি তাকে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বলে। পাকিস্তানীটি তখন আরও গলা উঁচিয়ে তাদের উদ্দেশ্য করে বলে- ৭১ সালে পাকিস্তানীরা ৯৯% বাঙালি নারীকে গর্ভবতী করে এসেছিল; এরপর থেকে বাঙালি একটা কালো, একটা সাদা, যেমনটি তোমরা দুইজন দুই রকম। এক বাঙালি আর ধৈর্য রাখতে পারে না। হাতের কাছে থাকা রান্নার বটি দিয়ে এক কোপে পাকিস্তানীকে দুই টুকরা। অর্থাৎ ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। পলকের মধ্যে ঘটে যায় ঘটনা। ছুটে আসে আশে পাশের মানুষ। আসে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হাতকড়া লাগিয়ে হত্যাকারীকে ধরে নিয়ে যায়।

ঘটনার অতঃপর: স্থানীয় মিডিয়ায় ফলাও করে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি প্রকাশ পায়। মুখে মুখেও খবরটি পৌঁছে যায় এক শহর থেকে অন্য শহরে। এরপর আদালতে মামলা উঠে। মামলায় বাঙালিটি খুন করেছে বলে স্বীকারোক্তি দেয়। আমীরাতের নিয়ম অনুযায়ী হত্যার সাজা হত্যা অর্থাৎ মৃতু্যদন্ড। তবে নিহতের নিকটাত্মীয়রা (স্ত্রী, সন্তান, মা, বাবা) যদি ক্ষমা করে দেয় তাহলে সাজা মওকুফ হতে পারে। অথবা যদি ৮০ লক্ষ দিরহাম (বাংলাদেশী মুদ্রায় ১২ কোটি) নগদ অর্থদন্ড পরিশোধ করা যায় তবে হত্যাকারী মুক্তি পেতে পারে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হলো নিহতের পরিবারের সাথে, কিন্তু লাভ হলো না। তারা কেবল উল্লিখিত অর্থদন্ডের পক্ষে অবস্থান নিলো।

হত্যাকারীর বাড়ি চট্টগ্রামের কোন এক অঁজপাড়াগাঁয়ে। দরিদ্র পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সে। এত টাকা পাবে কোথায়? নানান জনের নানান কথা-বার্তার মধে্য একটা কথাতেই সকলে একাত্ম হলেন যে ছেলেটি দেশপ্রমিক। দেশের অপমান সে সহ্য করতে পারেনি বলেই পাকিস্তানীকে হত্যা করেছে; তার সাহায্যার্থে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। ঘটনার বিস্তারিত শুনে আবুধাবী এলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণি। কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ হলো। তারা জানালেন যদি নির্দিষ্ট তারিখের আগে অর্থ পরিশোধ করা হয় তাহলে সে মুক্তি পাবে। এবার শুরু হলো প্রচারণা এবং অর্থ সংগ্রহ। দলমত নির্বিশেষে সকল বাঙালি এক কাতারে। এ যুবককে আমাদের বাঁচাতেই হবে। জাতির ইজ্জতের প্রশ্ন। অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালিরা আজ পর্যন্ত সম্মিলতভাবে যত কাজে হাত দিয়েছে সবগুলোতে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে এবং এক্ষেত্রেও ব্যর্থ হলো না। যতটুকু মনে পড়ে চট্টগ্রামের চেম্বার এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। অবশেষে আবুধাবীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নির্দিষ্ট তারিখের একদিন আগে নগদ অর্থ পরিশোধ করে বীরের মর্যাদায় ছাড়িয়ে আনলেন আজকের প্রজন্মের এ তরুণকে।
15.11.2014
সর্বোপর: এ ঘটনায় পুরো আরব ভূখন্ডে বিরাট চাঞ্চলে্যর সৃষ্টি হয়। বাঙালিদের এখন চরম ভয় পায় পাকিস্তানীরা। এখন কোন জায়গায় বাঙালিদের পাশে পাকিস্তানীরা বাসাবাড়ি ভাড়া নিতে সাহস পায় না। কর্মক্ষেত্রে বাঙালিদের সাথে কথাবার্তা বলতে এখন তারা হিসাব করে কথা বলে। অন্যদিকে অন্যান্য ভাষাভাষীদের মাঝে বাঙালি জাতি একটি দেশপ্রেমিক জাতি হিসেবে সম্মান লাভ করে।

সংযোজন: পুরো লেখাটা লিখেছিলাম স্মৃতি থেকে। লেখাটি পড়ে আমার এক বন্ধু রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশানাল (আরএফআই) থেকে প্রকাশিত ২০১০ সালের ১৬ মে তারিখের পত্রিকার একটি লিংক পাঠিয়েছেন। আরএফআই থেকে জানা যায়, ঘটনাটি ঘটে ২০০৭ সালে। এ ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ ঐ ঘর থেকে ৬ জন বাংলাদেশী তরুনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং তাদের সকলের বিরুদ্ধে পাকিস্তানীকে হত্যার অভিযোগ আনে (আমার লেখায় একজনের কথা উল্লেখ করেছিলাম)। পুলিশের ঐ রিপোর্টের ভিত্তিতে ৬ জনকেই মুতু্যদন্ডের শাস্তি ঘোষণা করে আদালত। আরএফআই সূত্রে আরও জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত ৬ জন বাংলাদেশীকে বাঁচাতে ১১১,৬২৭ ইউরো প্রদান করার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। উক্ত নির্দেশ মোতাবেক, আমীরাত আদালতের কাছে উল্লিখিত অর্থ পরিশোধ করার মাধ্যমে ৬ জন বাংলাদেশী শিরোচ্ছেদ-এর আদেশ থেকে রেহাই পায়। (আমার লেখাতে স্থানীয় বাংলাদেশীদের অর্থ সংগ্রহ যে কথাটি লিখা ছিল তা ঐ ৬ জন বীর বাঙালিকে দেশে যাওয়ার সময় উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হয় বলে জানতে পারলাম।)

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।