ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৯ জুলাই ২০২১
আজকের সর্বশেষ সবখবর

মালেয়শিয়াতে পেন্ডে আলীর খপ্পরে নি:স্ব ৬ শতাধিক বাংলাদেশী : দেশে হামলায় অর্থায়নের স্বীকার

Tito
জুলাই ২৯, ২০২১ ৬:০৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

মনিরুজ্জামান টিটো।।
২১ আগষ্টের বোমা হামলার যাবজ্জীবন সাঁজাপ্রাপ্ত আসামী ইকবাল হোসেন সেলিমকে মালেয়শিয়াতে আশ্রয়দাতা এবং স্বঘোষিত বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের মামলা ও নাশকতাসহ সরকার বিরোধী বিভিন্ন হামলায় অর্থযোগানদাতা আলী হোসেন ওরফে পেন্ডে আলীর খপ্পরে পড়ে সর্বোস্ব হারিয়েছেন মালেয়শিয়া প্রবাসী কয়েক’শ বাংলাদেশী। তাদের অনেকেই সব হারিয়ে অবৈধ হয়ে জেল খেটে ফিরেছেন দেশে। আবার অনেকেই অবৈধ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন মালেয়শিয়ার বনে জঙ্গলে। তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া প্রায় দশ কোটি টাকা নিয়ে দেশেই আয়েশ করছেন আলী হোসেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, যশোরের মণিরামপুর উপজেলার হুরগাতি গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান আলী হোসেন পার্শ্ববর্তী চালকিডাঙ্গা গ্রামে এক ব্যক্তির বাড়িতে থেকে কামলার কাজ করতেন। সেখান থেকে রোজগারের আশায় তিনি চলে যান যশোর শহরে। কিছুদিন শহরে ভ্যান-রিকসা চালানোর পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে ঝিকরগাছার গাজীর দরগাহ মাদরাসাতে ভর্তি হয়ে সেখানে এক ব্যক্তির বাড়িতে লজিং থাকেন। ঝিকরগাছায় থাকাকালীন লজিং কর্তার মাধ্যমে পরিচয় হয় স্থানীয় এক আদম ব্যবসায়ীর সাথে। ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর পথ পেয়ে যান আলী হোসেন। জড়িয়ে পড়েন আদম ও নারী পাচারের সাথে। প্রথমে বোম্বে এবং পরবর্তীতে সৌদিতে লোক পাঠানোর এজেন্টের কাজ শুরু করেন তিনি। নারী পাচারের বিষয়টি জানাজানি হলে কিছুটা চাঁপে পড়ে যান তিনি। সিদ্ধান্ত নেন নিজেই বিদেশে পাড়ি জমানোর। ওই আদম ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এবার সৌদি আরবে যাওয়া চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরে চলে যান মালেয়শিয়া।
মালেয়শিয়াতে গিয়ে একটা কোম্পানীতে শ্রমিকের কাজ নেন আলী হোসেন। সেখানে পরিচয় হয় তামিল সন্ত্রাসী গ্যাংস্টার গোপীর সাথে। গোপীকে সাথে নিয়ে আলী হোসেন মালেয়শিয়ার জোহরবারু রাজ্যে শুরু করেন বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে শ্রমিক সাপ্লাইয়ের কাজ। বৈধ-অবৈধ শ্রমিক দিয়ে বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে কাজ করিয়ে তাদের কয়েক মাসের বেতন আটকিয়ে রেখে নানা ভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে করেন বেতন আত্মসাত। মূহুর্তেই অঢেল টাকার মালিক হয়ে ওঠেন আলী হোসেন। খুলে বসেন ’’আলকোম্যাক্স রিসোর্স’’ নামে একটি কোম্পানী। যার মালেয়শিয়া সরকারের লাইসেন্স নং – 887542-W, নানা অভিযোগে পরবর্তীতে অবশ্য লাইসেন্সটি ব্লাক লিস্ট করে মালেয়শিয়ান সরকার।
অনেক শ্রমিক তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বেতনের টাকা না পেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করে পুলিশের হাতে আটক হয়ে জেল খেটে খালি হাতে দেশে ফিরেছে। অনেকে আবার প্রাণে বাঁচতে অন্য রাজ্যে বা বন এলাকায় পালিয়ে অবৈধ ভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
তার কোম্পানী দেখাশোনা করার জন্য দেশ থেকে নিয়ে গেছেন পাঁচ ভাগ্নেকে। তার অপরাধ সম্রাজ্য দেখভাল করতে পূর্ব পরিচিত ১৫ আগষ্টে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাস্থলে গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী ইকবাল হোসেন সেলিমকে জামিনে মুক্ত করে মালেয়শিয়াতে নিয়ে যান। আরেক বিএনপি ক্যাডার মিনারুলও যুক্ত হয় তাদের সাথে। সেখানে গোপী, মিনারুল ও সেলিমের নেতৃত্বে আলী হোসেন গড়ে তোলেন গ্যাংস্টার বাহিনী। শুরু করে এক চেটিয়া শ্রমিক সাপ্লাইয়ের কাজ। গ্রেনেড হামলা মামলার পলাতক যাবজ্জীবন সাঁজাপ্রাপ্ত আসামী সেলিমের জন্য আলী হোসেন ক্রয় করেন লেটেস্ট মডেলের হোন্ডা প্রাইভেট কার। গোপীর জন্যও আলাদা গাড়ী ক্রয় করেন আলী। ভাড়া করে দেন দামি ফ্লাট। বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিকদের শোষন নির্যাতনে শীর্ষ অবস্থানে আলী হোসেন মালেয়শিয়াতে বিএনপি নেতা ও ’’পেন্ডে আলী’’ নামে পরিচিত লাভ করে।
গ্রেনেড হামলা মামলার সাঁজাপ্রাপ্ত আসামী সেলিমের সুবাদে আলী হোসেন পরিচিত হন মালেয়শিয়াতে পলাতক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুত্র প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো’র সাথে। কোকো’র পারিবারিক ও দলীয় অনুষ্ঠানে আলী হোসেন বিপুল অর্থ ব্যায় করে রাতারাতি বিএনপি নেতা বনে যান। শুরু করেন বাংলাদেশের সরকার বিরোধী নানা অপতৎপরতা। বিএনপির এক কেন্দ্রিয় নেতার কাছে পাঠানো আলী হোসেনের একাধিক ভয়েজ রেকর্ড রির্পোটারের হাতে এসে পৌছালে তা শুনে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকার বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের জামিন করানোসহ নাশকতা সৃষ্টিতে হামলায় অর্থ দিয়েছেন তিনি। তিনি ওই রেকর্ডে আরোও বলেন, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনে খরচের বড় অংশ বিএনপির প্রার্থীর জন্য বহন করেছেন।
উল্লেখ্য, তার নিজ ইউনিয়ন মণিরামপুর উপজেলার ভোজগাতীসহ কয়েকটি ইউনিয়নে সৃষ্ট নাশকতায় ক্ষমতাসীন আ’লীগের প্রায় ৭ জন নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরন করেছেন প্রায় সাড়ে তিন’শ নেতা-কর্মী। দু’শতাধিক আ’লীগ নেতা-কর্মীর বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ভষ্মিভুত করা হয়েছে। পথে বসতে হয়েছে হাজারো নেতা-কর্মীকে।
এদিকে ২০১৬-১৭ সালে মালেয়শিয়ার ততকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজেক দেশে অবস্থানরত সকল অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ হওয়ার জন্য তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ‘’মাই-ইজি’’ কোম্পানীর মাধ্যমে রি-হেয়ারিং আবেদন ও রেজিষ্ট্রেশনের সুযোগ দেন। মাই-ইজি সেগুলো আবার রিক্রুটিং এজেন্টের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশনের কাজ শুরু করে। এসুযোগে আবারও ভাগ্য খুলে যায় আলীর। নিজ কোম্পানীর লাইসেন্স বাতিল ও ব্লাক লিস্টেডে হলেও সে তথ্য গোপন করে অফিস নিয়ে অবৈধদের বৈধ করনের রেজিষ্ট্রেশনের কাজ করে দিবেন বলে ধোঁকা দিতে শুরু করেন অসহায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের। প্রায় সাড়ে ৬’শ অবৈধ বাংলাদেশীদের বৈধ করার প্রলোভল দেখিয়ে তাদের কাজ থেকে পাসপোর্ট প্রতি ৪-৭ হাজার রিংগিত করে হাতিয়ে নেন প্রায় ৬-৭ কোটি টাকা। এর পরপরই তিনি পাল্টে ফেলেন অফিসের ঠিকানা। হাতিয়ে নেওয়া টাকা নিয়ে বাংলাদেশে এসে নিজ এলাকায় শুরু করেন বিএনপির রাজনীতি। এলাকার বিভিন্ন দলীয় অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে দান করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হতে শুরু করেন। এছাড়াও দান খয়রাত দিয়ে মিডিয়ার নজরে আসেন খুব অল্প সময়ে। বাদ যায়নি সরকার দলীয় অনুষ্ঠানেও অর্থায়ন করতে। ক্ষমতাসীন দলের কিছু লোভী স্থানীয় নেতাকে হাত করে দেদারচ্ছে দানবীর সেঁজে বসে আছেন।
অন্যদিকে মালেয়শিয়াতে আলী হোসেনের কোম্পানী আলকোম্যাক্স রিসোর্স ও তার লাইসেন্স বিভিন্ন অপরাধের কারনে নবায়ন না করে সে দেশের সরকার ব্লাক লিস্টেড করে দেওয়ার খবর জানাজানি হলে এবং দীর্ঘদিন পার হয়ে যাওয়ায় অবৈধ বাংলাদেশী আবেদকারীরা টাকা ফেরতের জন্য চাঁপ সৃষ্টি করতে থাকে। তখন সেলিম ও গোপী ওই সকল আবেদনকারীদের নানা ভাবে হুমকি ধামকির পাশাপাশি মারপিট করারও অভিযোগ ওঠে। এমনকি নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে বাদ দেননি নিজ ভাগ্নেকেও। গোপীর হাতে মারপিটের শিকার হয়েছে আলী হোসেনের নিজের ভাগ্নেরাও। বৈধ হওয়ার আশায় পাসপোর্ট জমা দেওয়া অবৈধ বাংলাদেশীরা আলীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে অনেকেই পাসপোর্ট ফেলে অন্যত্রে পালিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছে বলে জানা গেছে। দীর্ঘ প্রায় চার বছর অপেক্ষা করেও পাসপোর্ট ফেরত বা বৈধ হওয়ার সুযোগ বঞ্চিত অনেকেই আবার মালায়েশিয়ান পুলিশের হাতে আটক হয়ে সর্বস্ব খুঁইয়ে জেল খেটে দেশে থেকে টাকা নিয়ে বিমান টিকিট কেটে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছে।
অপরদিকে বিধি বাম ১৫ আগষ্টের বোমা হামলার যাজ্জীবন সাঁজাপ্রাপ্ত আসামী ইকবাল হোসেন সেলিমের। আলীর সকল অপকর্মের প্রধান সেনাপতি সেলিম নিজেও তার ভিসার মেয়াদ নবায়ন করতে পারেনি। এক পর্যায়ে মালেয়শিয়ান পুলিশ তাকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরন করে। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকার কয়েক মাস পর র‌্যাব তাকে আটক করে।
এদিকে আলী হোসেন ওরফে পেন্ডে আলী তার নিজ এলাকা যশোরের মণিরামপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিরোধী দল ও সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের সুপারিশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনুদান প্রদানসহ নানা সমাজসেবা মুলক কাজে নিয়োজিত করে নিজেকে দানবীর খ্যাতিতে পৌঁছে দিয়েছেন। এক পর্যায়ে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে নিয়েছেন গুণীজন সন্মাননা। এলাকাতে দানবীর সেজে গুনীজনের মুখোশের আড়ালে তার এহেন কর্মকান্ডে মালেয়শিয়া প্রবাসীরা চরম নিন্দা জানিয়েছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রবাসীরা।
আলী হোসেনের মালেয়শিয়ার অফিসে কর্মরত (বর্তমানে চাকুরিচ্যূত) সহকারী ইমরান হোসেন জানান, রি-হেয়ারিং প্রোগ্রামের সময় কিছু অবৈধ বাংলাদেশীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিলো, তখন কোম্পানী ব্লাক লিস্টেড হওয়াতে অন্য কোম্পানীর মাধ্যমে বৈধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাকি কিছু আলী বস বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালেয়শিয়ার জোহর বারুতে কর্মরত আলী হোসেনের ভাগ্নে ও ইনচার্জ আব্দুস সালাম জানান, যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে, তাদের কারো কারো ভিসা করে দেওয়া হয়েছে, আবার কারো কারো টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। আর বাকিরা যারা দেশে বা অন্যত্রে চলে গেছে, তারা কখনও আসলে টাকা দেওয়া হবে। আপাতত কোম্পানী কিছুটা বিপদে আছে বলে তাদের টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। শ্রমিকদের নির্যাতনের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, গোপী শ্রমিকদের সুপারভাইজার, শ্রমিক কন্ট্রোলে রাখতে সে কিছু করতেই পারে। এক পর্যায়ে তিনি রেগে গিয়ে টেলিফোনের লাইন কেটে দেন।
সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মালেয়শিয়া বিএনপির অন্যতম নেতা আলী হোসেন জানান, পনের আগষ্ট গ্রেনেড হামলার যাবজ্জীবন সাঁজাপ্রাপ্ত আসামী ইকবাল হোসেন সেলিম তার এলাকার লোক হিসেবে ও মালেয়শিয়াতে আঞ্চলিক সমিতি করার সুবাদে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক। সেলিমকে ব্যবহারের জন্য গাড়ী দেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুলত গাড়ীটি সেলিমের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে নাম পরিবর্তন করে দেননি বলে জানান।
তামিল সন্ত্রাসী গোপী সম্পর্কে আলী হোসেন জানান, গোপী তার বেতনভুক্ত কর্মচারী। সে শ্রমিকদের সবকিছুই সুপারভাইজ করে।
যুবদল, ছাত্রদল ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের জামিন ও বিভিন্ন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর জন্য অর্থায়নের কথা স্বীকার করলেও আলী হোসেন নাশকতা ও বিভিন্ন হামলায় নেতা-কর্মীদের অর্থায়নের বিষয়ে বলেন, ‘’ওটা ভুল করে বলে ফেলেছি। আসলে মুখ ফসকে বলা হয়ে গেছে। হামলায় টাকা দেওয়ার কথাটা বলা হয়ে গেছে কথার কথার মতো।’’

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।